Tuesday, November 6, 2018

ওয়াহবী আন্দোলন

ভূমিকাঃ ওয়াহবী আন্দোলন ভারতীয় উপমহাদেশে সর্বপ্রথম সুসংগঠিত ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন (Anti British Movement)। এন কে সিনহা (NK Sinha) বলেছেন, "এই আন্দোলন ভারতের ইতিহাসে প্রথম জাতীয়তাবাদী আন্দোলন।" ওয়াহাবী আন্দোলন শুরু করেছিলেন মুহাম্মদ বিন আব্দুল ওয়াহাব(১৭০৩-১৭৮৭ খ্রি.) সৌদিআরবের নজদ প্রদেশে। ইসলামকে তার আদি বিশুদ্ধতায় ফিরিয়ে আনা ছিল এই আন্দোলন এর মূল উদ্দেশ্য। ভারত বর্ষে এই আন্দোলন শুরু করেন সৈয়দ আহমদ বেরিলি(১৭৮৬-১৮৩১ খ্রি.)। বাংলায় ওয়াহাবী আন্দোলন শুরু করেন মীর নেসার আলী তিতুমীর(১৭৮১-১৮৩১ খ্রি.)। ওয়াহাবী আন্দোলন সম্পর্কে কিয়াম উদ্দিন আহমেদ তার গ্রন্থে বলেছেন, "The Wahabi Movement was earliest of the most consists and protected and the most remorselessly 'Anti British Movement' which characteristic the political history of India in the second half of the eighteen and the early nineteen century."


ওয়াহাবি আন্দোলন (Wahabi movements):- ‘ওয়াহাবি’ শব্দের অর্থ হল ‘নবজাগরণ’ ।১৮ শতকের  মাঝামাঝি সময়ে আরব দেশে মুহাম্মদ আব্দুল ওয়াহাব (১৭০৩-৮৭ খ্রি. ) নামে এক ধর্মপ্রাণ ব্যক্তি ইসলাম ধর্মের সংস্কারের জন্য এই আন্দোলনের সূচনা করেছিলেন। পরবর্তীতে তারই নাম অনুসারে এ আন্দোলন এর নাম করণ করা হয় ওয়াহাবী আন্দোলন।

ভারতে ওয়াহাবী আন্দোলনের বর্ণনাঃ ভারতবর্ষে ওয়াহাবি আন্দলনের প্রকৃত প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন উত্তরপ্রদেশের রায়বেরিলির অধিবাসী শাহ সৈয়দ আহমদ (১৭৮৬-১৮৩১ খ্রি.) এবং তাঁর অনুগামীদের নেতৃত্বে ওয়াহাবি আন্দোলন অচিরেই একটি রাজনৈতিক আন্দোলনে পরিণত হয়। ১৮২০ থেকে ১৮২২ সাল পর্যন্ত ভারতের নানান স্থান পরিভ্রমণ করে তিনি ওয়াহাবি আন্দোলনের আদর্শ প্রচার করেন। প্রথম দিকে এই আন্দোলন ছিল ধর্মীয় সংস্কার আন্দোলন এবং এর মুখ্য উদ্দেশ্য ছিল ইসলামের শুদ্ধিকরণ।  সৈয়দ আহমদ (১৭৮৬-১৮৩১ খ্রি.) আরবের ওয়াহাবিদের অনুকরণে ধর্মসংস্কারের কথা প্রচার করতে শুরু করেন। তাঁর এই আন্দোলন এর অন্যতম সহযোদ্ধা ছিলেন, (i) মৌলভী ঈসমাইল আলী (ii) মৌলভী মাসুম আলী (iii) মৌলভী বেলায়েত আলী (iv) মৌলভী এনায়েত আলী।

ওয়াহাবি আন্দোলন মূলত ধর্মসংস্কার আন্দোলন হিসাবে শুরু হলেও অচিরেই তা রাজনৈতিক আন্দোলনের পরিণতি লাভ করে। সৈয়দ আহমদ বলেন, ইংরেজ শাসনের ফলে ভারতবর্ষ ‘দার-উল-হার্ব’ বা বিধর্মীর দেশে পরিণত হয়েছে, একে ‘দার-উল-ইসলাম’ অর্থাৎ ইসলামের দেশে পরিণত করতে হবে। সুতরাং এই আন্দোলনের রাজনৈতিক উদ্দেশ্য ছিল বিধর্মী ইংরেজ শাসন উচ্ছেদ করে মুসলমান শাসন প্রতিষ্ঠা করা।


ওয়াহাবিগণ দ্রুত ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে শক্তিশালী সংগঠন গড়ে তোলেন । ১৮২৭ খ্রিস্টাব্দে পাঞ্জাবে শিখ শাসনের অবসান ঘটাবার জন্য তাঁরা ধর্মযুদ্ধ শুরু করেন । ১৮৩০ খ্রিস্টাব্দে ওয়াহাবিগণ পশ্চিম পাঞ্জাবের রাজধানী পেশোয়ার জয় করেন । কিন্তু তাদের এই সাফল্য বেশিদিন স্থায়ী হয় নি । ১৮৩১ খ্রিস্টাব্দে বালাকোটের যুদ্ধে সৈয়দ আহম্মদ প্রাণ হারান এবং ওয়াহাবিরা পরাস্ত হন । পাঞ্জাবে ইংরেজ শাসন প্রতিষ্ঠিত হবার পর আবার ওয়াহাবিগণ ইংরেজদের বিরুদ্ধে অস্ত্রধারণ করেন । ক্রমশ বাংলা, বিহার, মীরাট ও অন্ধ্রের হায়দরাবাদে ওয়াহাবি আন্দোলন বিস্তারলাভ করে ।

বাংলায় ওয়াহাবী আন্দোলনের বর্ণনাঃ ১৯ শতকের শেষের দিকে বা মাঝামাঝি সময়ে বাংলায় সৈয়দ আহমদ পরিভ্রমণে আসেন। এ সময় বাংলা মুসলমানরা ওয়াহাবীদের সাহায্য করেন। বাংলায় ওয়াহাবি আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন মীর নিশার আলি বা তিতুমীর (১৭৮২-১৮৩১খ্রি.)।

তিতুমীরের পরিচয়ঃ মীর নেসার আলী ওরফে তিতুমীর চব্বিশ পরগনার বারাসাত মহাকুমার চাঁদপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম মীর হাসান আলী এবং মাতার নাম আবিদা রোকেয়া খাতুন। তিতুমীরের প্রাথমিক শিক্ষা হয় তাঁর গ্রামের বিদ্যালয়ে। পরবর্তীকালে তিনি স্থানীয় একটি মাদ্রাসাতে লেখাপড়া করেন। ১৮ বছর বয়সে তিতুমীর কোরানে হাফেজ হন এবং হাদিস বিষয়ে পাণ্ডিত্য লাভ করেন। একই সাথে তিনি বাংলা , আরবি ও ফার্সি ভাষায় ব্যুৎপত্তি লাভ করেন। প্রথম জীবনে তিনি একজন লাঠিয়াল ছিলেন। কোন এক হিন্দুু জমিদার এর অধীনে খাজনা আদায় করতেন। এ সময় এক ঝামেলায় ফৌজদারী মামলায় কারাবন্দী হন। এরপর তিনি ধর্মের দিকে ঝুকে পড়েন।


ব্রিটিশ বিরোধী ওয়াহাবী আন্দোলনের ভূমিকাঃ ১৮২২ সালে তিতুমীর মক্কায় হজ্জব্রত পালনের উদ্দেশ্যে যান। সেইখানেই তিনি রায়বেরিলির সৈয়দ আহম্মদের সংস্পর্শে আসেন এবং তাঁর শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন । মক্কা থেকে দেশে ফিরে তিনি ওয়াহাবি আদর্শ অনুসারে ইসলাম ধর্মের সংস্কারে আত্মনিয়োগ করেন। তিনি নারিকেল বাড়িয়ায়র নিকটবর্তী হায়দারপুরে খানকা স্থাপন করে তরিকায়ে মুহাম্মদিয়া সুন্নি মতবাদ প্রচার করেন। অচিরেই তিনি একটি শক্তিশালী সংগঠন ভিত্তিক সামাজিক ও ধর্মীয় আন্দোলনের নেতা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন। জমিদার ও মহাজনদের অত্যাচার ও শোষণের বিরুদ্ধে তিতুমীরের প্রচারের ফলে দরিদ্র ও নিম্নশ্রেণির বহু মুসলমান দলে দলে তাঁর শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন। প্রথম প্রথম ওয়াহাবিদের সংগ্রাম ছিল স্থানীয় জমিদার, মহাজন ও নীলকরদের বিরুদ্ধে।

জনসাধারণের অর্থ সাহায্যে তিতুমীর বাদুড়িয়া থানার দশ কিলোমিটার দুরে নারকেলবেড়িয়া গ্রামে বাঁশের কেল্লা নির্মাণ করে দলবলসহ সেখানে অবস্থান করেন এবং ইংরেজদের বিরুদ্ধে শক্ত প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। লর্ড বেন্টিঙ্ক তিতুমীরকে বাধা দিলে উভয় পক্ষের মধ্যে যুদ্ধ শুরু হয়। তিতুমীর তাঁর ৬০০ অনুগামী কাঁচা বেল, ইট, তীর, ধনুক, বর্শা ইত্যাদি নিয়ে বাঁশের কেল্লা থেকে ব্রিটিশদের উপর আঘাত হানে। শেষ পর্যন্ত ১৮৩১ খ্রিস্টাব্দের নভেম্বর মাসে মেজর স্কটের নেতৃত্বে এক শক্তিশালী ইংরেজ বাহিনী তিতুমীর ও তাঁর অনুগামীদের পরাজিত করেন। তিতুমীর তাঁর বহু অনুগামীসহ যুদ্ধক্ষেত্রে প্রাণত্যাগ করেন। তিতুমীরের সেনাপতি গোলাম মাসুম খাঁ ইংরেজদের হাতে ধারা পড়েন। তাঁকে কেল্লার সামনেই ফাঁসি দেওয়া হয়। এই ঘটনাই বারাসত বিদ্রোহ নাম পরিচিত ছিল।  প্রত্যক্ষদর্শী সাধারণ মানুষ এই ঘটনায় আরও ঘোরতর ইংরেজ বিদ্বেষী হয়ে ওঠেন।

উপসংহারঃ পরিশেষে এ কথা বলা যায় যে বাংলায় ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন এর মধ্য তিতুমীরের ওয়াহাবী আআন্দোলন ছিল অন্যতম। তিতুমীর প্রথম দিকে সংস্কার মুলক আন্দোলন করলেও তার পাশে সকল শ্রেণীর শোষিত মানুষ এসে দাড়ায়। এতে হিন্দু জমিদাররা উদ্দেশ্যমুলক বিরোধীতা করে। তিতুমীর আদালতের সরনাপন্ন হন, কিন্তু সরকারের কোন সহযোগীতা না পাওয়ায় অস্ত্র ধারণ করতে বাধ্য হন।

No comments:

Post a Comment